- Get link
- X
- Other Apps
জামিন পাওয়া আসামীর অধিকার; এটি তারা প্রতি আনুকূল্য নয়।
জামিন
এই উক্তিটি ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিকে নির্দেশ করে। এর অর্থ হলো, জামিন আদালতের কোনো দয়া বা অনুকম্পা নয়, বরং আইনের সুনির্দিষ্ট বিধান দ্বারা স্বীকৃত আসামীর একটি আইনগত অধিকার। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে নির্দোষ হিসেবেই গণ্য করা হয় (Presumption of innocence)। এই মৌলিক নীতিটির উপর ভিত্তি করেই জামিনের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন অহেতুক দীর্ঘকাল কারাগারে আটক না থাকে এবং তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা (personal liberty) সুরক্ষিত থাকে।
জামিনযোগ্য অপরাধ (Bailable Offence) এর ক্ষেত্রে এই ধারণার প্রয়োগযোগ্যতা:
জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে "জামিন পাওয়া আসামীর অধিকার" - এই ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য এবং এটি ফৌজদারি কার্যবিধির সুস্পষ্ট বিধান দ্বারা নিশ্চিত।
সংশ্লিষ্ট বিধান: ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ৪৯৬
ধারা ৪৯৬ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি জামিনযোগ্য অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং তিনি জামানত (surety) দিতে প্রস্তুত থাকেন, তবে পুলিশ কর্মকর্তা বা আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দিতে বাধ্য। এখানে আদালতের কোনো বিবেচনামূলক ক্ষমতা (discretionary power) নেই; জামিন মঞ্জুর করা বাধ্যতামূলক। আসামী জামিন পাওয়ার দাবিদার।
ফৌজদারি কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিল এবং অন্যান্য বিশেষ আইনে (যেমন: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, দুর্নীতি দমন আইন ইত্যাদি) কোন অপরাধগুলো জামিনযোগ্য তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা আছে। সাধারণত, কম গুরুতর অপরাধগুলো জামিনযোগ্য হয়ে থাকে।
জামিন অযোগ্য অপরাধ (Non-Bailable Offence) এর ক্ষেত্রে এই ধারণার প্রয়োগযোগ্যতা:
জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে "জামিন পাওয়া আসামীর অধিকার" - এই ধারণার প্রয়োগ কিছুটা ভিন্ন। এক্ষেত্রে জামিন আসামীর আইনগত অধিকার নয়, বরং আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। তবে, এর অর্থ এই নয় যে আদালত স্বেচ্ছাচারীভাবে জামিন প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। আদালতকে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি, কারণ এবং উচ্চ আদালতের নজির (precedents) অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
সংশ্লিষ্ট বিধান: ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ৪৯৭
ধারা ৪৯৭ জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন সংক্রান্ত মূল বিধান। এই ধারায় বলা হয়েছে:
যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ সংঘটনের যুক্তিসঙ্গত বিশ্বাস করার মতো কারণ থাকে, তবে সাধারণত তাকে জামিন দেওয়া হবে না।
তবে, এই সাধারণ নিয়মের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমও রয়েছে:
যদি আসামী নারী হন, অথবা শিশু (১৬ বছরের কম বয়সী পুরুষ), অথবা অসুস্থ (sick) বা দুর্বল (infirm) ব্যক্তি হন, তাহলে আদালত তাদের জামিন দিতে পারেন, এমনকি যদি তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের যুক্তিসঙ্গত কারণও থাকে। এটি মানবিক বিবেচনার উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত একটি সুবিধা।
যদি তদন্ত, অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পর্যায়ে আসামীর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের যুক্তিসঙ্গত কারণ না পাওয়া যায়, তবে আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।
যদি কোনো আসামীর বিচার অযৌক্তিকভাবে দীর্ঘায়িত হয় এবং মামলার নিষ্পত্তি হতে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আদালত জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। (যদিও এটি সরাসরি ধারায় উল্লেখ নেই, উচ্চ আদালতের অসংখ্য রায়ে এটি একটি নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত)।
আদালতকে জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে তার কারণ লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য।
সংশ্লিষ্ট বিধান: ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ৪৯৮
ধারা ৪৯৮ উচ্চ আদালত (যেমন: হাইকোর্ট বিভাগ ও দায়রা আদালত) কে জামিন মঞ্জুরের ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে। এই ধারা অনুযায়ী:
হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা আদালত যেকোনো ব্যক্তিকে, যেকোনো জামিনযোগ্য বা জামিন অযোগ্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলেও, জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে।
এই ক্ষমতা অত্যন্ত ব্যাপক এবং এটি "বিশেষ ক্ষমতা" হিসেবে পরিচিত। উচ্চ আদালত এই ক্ষমতার বলে যেকোনো পরিস্থিতিতে জামিন মঞ্জুর করতে পারে, যদি তারা তা ন্যায়সঙ্গত মনে করে। তবে, এই ক্ষমতাও স্বেচ্ছাচারী নয়, বরং ন্যায়বিচার ও উচ্চ আদালতের প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়।
সাধারণত, আগাম জামিন (anticipatory bail) এই ধারার অধীনেই মঞ্জুর করা হয়, যেখানে কোনো ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার আগেই জামিনের জন্য আবেদন করতে পারেন।
মন্তব্য:
"জামিন পাওয়া আসামীর অধিকার; এটি তারা প্রতি আনুকূল্য নয়" - এই উক্তিটি জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে একটি আইনগত ও অলঙ্ঘনীয় অধিকারের স্বীকৃতি। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৬ এটিকেই নিশ্চিত করে।
অন্যদিকে, জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে যদিও জামিন সরাসরি অধিকার নয় বরং আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতার অধীন (ধারা ৪৯৭), তবে এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আদালতকে অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত, ন্যায়সঙ্গত এবং মানবিক হতে হয়। আদালতকে মনে রাখতে হয় যে, আসামীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। ধারা ৪৯৮ এর অধীনে উচ্চ আদালতের বিশেষ ক্ষমতা এই নীতিরই প্রতিফলন ঘটায়, যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যেকোনো পরিস্থিতিতে জামিন মঞ্জুর করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় জামিন কোনো দয়া নয়, বরং আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর উদ্দেশ্য হলো বিচার প্রক্রিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখা, যেখানে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত উভয়ের অধিকারই সুরক্ষিত থাকে এবং কেউই বিনা বিচারে দীর্ঘকাল কারাবন্দী না থাকে।