- Get link
- X
- Other Apps
বার কাউন্সিল ও জুডিসিয়াল সার্ভিস লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি - পর্ব ১৬
দলিলপত্র (Documents) সংক্রান্ত:
একটি সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায়, একটি পুরাতন বিক্রয় দলিল আদালতে পেশ করা হলো। এই দলিলের সত্যতা কিভাবে প্রমাণ করা হবে?
একটি ই-মেইল বা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটকে কি আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে? যদি যায়, কিভাবে এর সত্যতা প্রমাণ করা হবে?
মৌখিক সাক্ষ্য (Oral Evidence) সংক্রান্ত:
একটি চুক্তি লিখিত আকারে ছিল, কিন্তু চুক্তিভুক্ত পক্ষরা মৌখিকভাবে কিছু শর্ত যোগ করেছিল। এই মৌখিক শর্তগুলো কি আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে?
একজন সাক্ষী একটি ঘটনা বর্ণনা করছেন যা তিনি নিজে দেখেননি, বরং অন্যের কাছে শুনেছেন। তার এই মৌখিক সাক্ষ্য কি গ্রহণযোগ্য হবে?
প্রচলিত আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের আদালতে কোনো দলিল বা সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। নিচে আপনার উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
পুরাতন বিক্রয় দলিলের সত্যতা প্রমাণ
একটি পুরাতন বিক্রয় দলিল আদালতে উপস্থাপন করা হলে এর সত্যতা প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ৬১, ৬২, ৬৩, ৬৪ এবং ৬৫ ধারাগুলো প্রাসঙ্গিক।
ধারা ৬১: এই ধারা অনুযায়ী, কোনো দলিলের বিষয়বস্তু প্রাথমিক বা মাধ্যমিক সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণ করা যেতে পারে। দলিলটি প্রাথমিক সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণের জন্য মূল দলিলটি আদালতে পেশ করতে হয়।
ধারা ৬২: এই ধারা অনুযায়ী, প্রাথমিক সাক্ষ্য হলো মূল দলিলটি। যদি কোনো একটি দলিল বিভিন্ন অংশে লিখিত হয়, তবে প্রতিটি অংশই প্রাথমিক সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
![]() |
প্রাথমিক সাক্ষ্য হলো মূল দলিলটি। |
ধারা ৬৩: এই ধারা অনুযায়ী, মাধ্যমিক সাক্ষ্য বলতে সেই সাক্ষ্যকে বোঝানো হয় যা মূল দলিলের অবর্তমানে এর বিষয়বস্তু প্রমাণ করে। মাধ্যমিক সাক্ষ্যের কিছু উদাহরণ হলো:
✓মূল দলিলের নকল যা মূল থেকে তৈরি এবং পরীক্ষা করা হয়েছে।
✓যান্ত্রিক প্রক্রিয়া দ্বারা তৈরি নকল (যেমন ফটোগ্রাফ, ফটোকপি, স্ক্যান করা কপি)।
✓দলিলের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনো ব্যক্তির মৌখিক বর্ণনা।
ধারা ৬৪: এই ধারা অনুযায়ী, কোনো দলিলের বিষয়বস্তু অবশ্যই প্রাথমিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ করতে হবে, যদি না ধারা ৬৫-তে বর্ণিত কোনো ব্যতিক্রম থাকে।
ধারা ৬৫: এই ধারা অনুযায়ী, কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক সাক্ষ্য দ্বারাও দলিলের বিষয়বস্তু প্রমাণ করা যায়। যেমন:
✓যখন মূল দলিলটি কোনো প্রতিপক্ষের দখলে থাকে এবং সে নোটিশ সত্ত্বেও তা আদালতে পেশ করে না।
✓যখন মূল দলিলটি ধ্বংস হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়।
✓যখন মূল দলিলটি সহজে সরানো যায় না।
✓যখন মূল দলিলটি অনেক বেশি সংখ্যক দলিলের সমষ্টি, যা পৃথকভাবে পরীক্ষা করা কঠিন।
যদি দলিলটি ৩০ বছর বা তার বেশি পুরনো হয়, তাহলে সাক্ষ্য আইনের ধারা ৯০ অনুযায়ী আদালত একটি অনুমান করতে পারে যে দলিলটি যথাযথভাবে সম্পাদিত হয়েছে এবং এর স্বাক্ষরগুলো সঠিক। তবে, এই অনুমানটি একটি খণ্ডনযোগ্য অনুমান (rebuttable presumption), অর্থাৎ বিরোধী পক্ষ উপযুক্ত সাক্ষ্য দিয়ে এটি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারে।
ই-মেইল বা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন
হ্যাঁ, একটি ই-মেইল বা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটকে আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে। বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ধারা ৬৫এ এবং ৬৫বি অনুযায়ী ইলেকট্রনিক রেকর্ডকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার বিধান আছে।
ধারা ৬৫এ: এই ধারা অনুযায়ী, কোনো ইলেকট্রনিক রেকর্ড এবং এর বিষয়বস্তু, সাক্ষ্য আইনের বিধান অনুযায়ী দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হবে।
ধারা ৬৫বি: এই ধারা ইলেকট্রনিক রেকর্ডকে প্রমাণের জন্য বিস্তারিত পদ্ধতি বর্ণনা করে। এর মূল শর্তগুলো হলো:
✓ইলেকট্রনিক রেকর্ডটি একটি কম্পিউটার আউটপুট হিসেবে গণ্য হবে।
✓রেকর্ডটি যে কম্পিউটার বা ডিভাইস থেকে তৈরি হয়েছে, তা নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত হতো।
✓রেকর্ডটি যে সময়ে তৈরি হয়েছিল, সেই সময় কম্পিউটারটি সঠিকভাবে কাজ করছিল।
✓তথ্যটি যে উৎস থেকে নেওয়া হয়েছিল, তা যথাযথ ছিল।
এই ধারা অনুযায়ী, যিনি ইলেকট্রনিক রেকর্ডটি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চান, তাকে একটি সার্টিফিকেট বা হলফনামা দিতে হবে। এই সার্টিফিকেটে অবশ্যই ৬৫বি(৪) ধারায় বর্ণিত সকল শর্ত পূরণ করতে হবে, যেমন:
✓সার্টিফিকেট প্রদানকারীর পরিচয় এবং পদ।
✓ইলেকট্রনিক রেকর্ডটি কোথা থেকে এবং কিভাবে তৈরি হয়েছে তার বর্ণনা।
✓রেকর্ডটির সত্যতা এবং সঠিকতা নিশ্চিতকরণ।
✓রেকর্ডটি যে ডিভাইস থেকে তৈরি হয়েছে, তার বিবরণ।
মৌখিক সাক্ষ্য (Oral Evidence) সংক্রান্ত
চুক্তির মৌখিক শর্ত:
একটি লিখিত চুক্তির ক্ষেত্রে কিছু মৌখিক শর্ত যোগ করা হলে, সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ধারা ৯১ এবং ৯২ অনুযায়ী সেই মৌখিক শর্তগুলো সাধারণত আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না।
ধারা ৯১: এই ধারা অনুযায়ী, যখন কোনো চুক্তি, অনুদান বা সম্পত্তির নিষ্পত্তি লিখিত আকারে থাকে, তখন সেই বিষয়বস্তু প্রমাণের জন্য শুধুমাত্র সেই লিখিত দলিলটি বা মাধ্যমিক সাক্ষ্য (যেমন ফটোকপি) উপস্থাপন করতে হবে। মৌখিক সাক্ষ্য দ্বারা সেই লিখিত চুক্তির শর্ত পরিবর্তন, যোগ বা বাদ দেওয়া যাবে না।
ধারা ৯২: এই ধারা অনুযায়ী, যখন কোনো লিখিত দলিলকে ধারা ৯১ অনুযায়ী প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তখন সেই দলিলের শর্তাবলী পরিবর্তন, সংশোধন, বা বাতিল করার জন্য মৌখিক চুক্তি বা বক্তব্যের সাক্ষ্য প্রদান করা যাবে না।
তবে, এই ধারার কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন:
✓যদি মৌখিক চুক্তিটি লিখিত চুক্তির কোনো ফাঁকা অংশ পূরণ করে।
✓যদি মৌখিক চুক্তিটি কোনো প্রতারণা, হুমকি বা জবরদস্তির কারণে লিখিত চুক্তিকে প্রভাবিত করে।
✓যদি লিখিত চুক্তিটি একটি শর্ত সাপেক্ষে ছিল এবং মৌখিক চুক্তি দ্বারা সেই শর্তটি প্রমাণ করা হয়।
শোনা কথা (Hearsay Evidence):
একজন সাক্ষী যদি কোনো ঘটনা সম্পর্কে অন্যের কাছে শুনে বর্ণনা করে, তাহলে তার এই মৌখিক সাক্ষ্যকে শোনা কথা বা hearsay evidence বলা হয়। সাক্ষ্য আইনের সরাসরি কোনো ধারা এই বিষয়ে নেই, তবে এই ধরণের সাক্ষ্য সাধারণত আদালতে গ্রহণযোগ্য হয় না। এর প্রধান কারণ হলো, যিনি ঘটনাটি বর্ণনা করছেন তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নন। তাই, এই সাক্ষ্যের সত্যতা যাচাই করা কঠিন।
এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও আছে। যেমন:
মৃত্যুকালীন ঘোষণা (Dying Declaration): যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর আগে কোনো ঘটনা সম্পর্কে মৌখিক বা লিখিতভাবে কিছু বলে যায়।
যেসব বক্তব্য একই ঘটনার অংশ (Res Gestae): যখন কোনো বক্তব্য এমন একটি ঘটনার অংশ যা তাৎক্ষণিকভাবে ঘটেছিল। উদাহরণস্বরূপ, একটি দুর্ঘটনার পর একজন ব্যক্তি যদি তাৎক্ষণিকভাবে বলে, "ওই গাড়িটি আমার উপর দিয়ে চালিয়ে গেলো," তবে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
মূলনীতি হলো, সাক্ষ্য হতে হবে সরাসরি এবং প্রত্যক্ষ। যদি কোনো ব্যক্তি নিজে কিছু দেখে, শুনে বা অনুভব করে থাকে, কেবল তখনই তার মৌখিক সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে। শোনা কথা প্রমাণের মূল্য খুবই কম, এবং আদালত সাধারণত এটি এড়িয়ে চলে, যদি না কোনো আইনগত ব্যতিক্রম থাকে।